টিস্যু কালচার কি

টিস্যু কালচার কি
5/5 - (1 vote)

মাশরুমের বীজ উৎপাদন ও টিস্যু কালচার আমরা জানি কৃষি উৎপাদনে নতুন ফসল ফলানোর জন্যে অন্যতম উপকরণ হলো বীজ। সাধারণভাবে বীজ দুই প্রকারের:

 (১) উদ্ভিদতাত্ত্বিক বীজ (Botanical Seed) এবং কৃষিতাত্ত্বিক বীজ (Agronomical Seed)। কার্যত আমরা সাধারণভাবে বাঁজ বলতে উদ্ভিদতাত্ত্বিক বীজকেই বুঝে থাকি, যেমন ধান, গম, ছোলা, মোটর, মত্তরের বীজ। 

অন্যদিকে পটলের শেকড়, আখের দত্ত, মিষ্টি আলুর লতা এসবই কৃষিতাত্ত্বিক বীজ। তেমনিভাবে মাশরুমের বীজও কৃষিতাত্ত্বিক বীজ যা স্পন (Spawn) নামে পরিচিত। স্পনের মধ্যে মাশরুমের সুভাকারের মাইসেলিয়াম থাকে।

 মাশরুমের এই স্পন বীজ ল্যাবরেটরিতে পরিচ্ছন্ন পরিবেশে তৈরি করতে হয়; যেখানে সেখানে যেকোনোভাবে মাশরুমের বীজ তৈরি করা একেবারেই অসম্ভব। এটা অনেকটা ধান বা শাকসবজির হাইব্রীড বীজের মতো যা যেনতেনভাবে অন্যান্য বীজের মত তৈরি করাটা বেশ জটিল। 

মাশরুমের বীজ স্পন তৈরির জন্যে দরকার বিশেষ ধরনের যন্ত্রপাতি, পরিচ্ছন্ন ল্যাবরেটরি এবং দক্ষ জনবল। যারা স্পন প্যাকেট কিনে এনে মাশরুম চাষ করবেন তাদেরকে অবশ্যই বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান থেকে ভালোমানের মাশরুম বীজ কিনতে হবে, 

অন্যথায় ভেজাল বীজ কিনলে মাশরুম চাষের অভিলাষ শুরুতেই বাধাগ্রস্থ হতে পারে। সপ্তদশ শতাব্দী থেকেই আস্তাবলের কম্পোস্ট সারের গাদায় যে মাইসেলিয়াম বা অণুসূত্র ব্যবহৃত হতো, কালের বিবর্তনে সেটাই আজকের মাশরুম বীজ বা মাইসেলিয়াম।

 ইতিহাসের পথপরিক্রমায় যেভাবে আজকের আধুনিক মাশরুম বীজ উৎপাদন প্রক্রিয়ার গোড়াপত্তন হয়েছে, আমরা সে সম্পর্কে কিছুটা জেনে নিতে পারি।

 ভার্জিন স্পন (Virgin spawn): 

মাশরুমের স্পন তৈরির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৬১ সালে ভার্জিন স্পন ফ্রান্সে তৈরি হতো এবং সেটা তারা সে সময় বিদেশে রপ্তানি করত। 

উপযুক্ত যৌগের ওপর বাছাই করা মাশরুম রেণু (spawn) ছিটিয়ে ছত্রাকের মাইসেলিয়াম বা অণুসূত্র তৈরি করা হতো। অণুসূত্র জট পাকিয়ে গেলে যৌগসহ তুলে নিয়ে সেটা মাশরুমের বীজ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। 

ফ্রেক স্পন (Flake spawn): 

কেয়ারিতে রাখা কম্পোস্ট যখন মাইসেলিয়ামে ঢেকে যেত, তখন ঐ কম্পোস্টকে ভেঙে শুকিয়ে নিয়ে নতুন কেয়ারিতে বীজ স্পন করা হতো। এটাকেই ফ্লেক স্পন বলে। 

 (Grain spawn): 

ধান বা গমকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে তাতে মাইসেলিয়াম তৈরি করা হতো। দানার মধ্যে জড়ানো মাইসেলিয়ামকে গ্রেন স্পন বলা হয়। একটা সময় এই গ্রেন স্পন ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিক মাশরুম চাষে ব্যবহৃত হতো।

এভাবে নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা ও গবেষণার পরে আজকের দিনে আধুনিক বীজ মাশরুম স্পন ল্যাবরেটরিতে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় তৈরি করা হয়ে থাকে। 

এখন আমরা জানতে চেষ্টা করি হাল আমলে কীভাবে গবেষণাগারে পরিচ্ছন্ন মাশরুম তৈরি করা হয়ে থাকে। এখন পর্যায়ক্রমিকভাবে চারটি পৃথক পৃথক ধাপে মাশরুম বীজের স্পন প্যাে তৈরি করা হয়ে থাকে: এই ধাপগুলো হলো:

টিস্যু কালচার

  •  পিডিএ মিডিয়া প্রস্তুত ।
  • পিউর কালচার তৈরির 
  •  মাদার কালচার তৈরি। 
  • বাণিজ্যিক স্পন তৈরি। 

পিডিএ মিডিয়া প্রস্তুত প্রণালি:

 পিডিএ মিডিয়ার (PDA Media) অর্থ হলো Potato Dextrose Agar (PDA) যা কোনো ছত্রাকের বংশবিস্তারের জন্যে ব্যবহার করা হয়। পিডিএ মিডিয়া অ্যাসিডধর্মী এবং ব্যাকটেরিয়ারোধী হওয়ার কারণে এখানে ছত্রাকের মাইসেলিয়াম খুব সহজে গজাতে পারে। এক লিটার পিডিএ মিডিয়া তৈরির জন্যে আমাদের প্রয়োজন: 

  • গোল আলু (Potato ) ২৫০ গ্রাম। 
  • গ্লুকোজ (Glucose) ২০ গ্রাম।
  •  এগার এগার (Agar agar) পাউডার ২০ গ্রাম। (লাল জাতের শৈবাল থেকে তৈরি একধরনের পাউডার, যা পানিতে মেশালে আঠালো হয়)।
  •  এসপারজিন (Asparagine) ২৫০ মিলিগ্রাম।এটা একধরনের অ্যামাইনো অ্যাসিড।

 প্রথমে আলুর ওপরের ছাল উঠিয়ে ফেলে টুকরা টুকরা করে কেটে ১ লিটার পানির মধ্যে দিয়ে সিদ্ধ করতে হবে। সিদ্ধ করার পরে ছাকনি দিয়ে পানিটুকু ছেঁকে নিয়ে সেই পানির মধ্যে গ্লুকোজ ২০ গ্রাম, এগার এগার ২০ গ্রাম এবং এসপারজিন ২৫০ মিলিগ্রাম মিশিয়ে আবার ১৫ মিনিট ধরে ঐ মিশ্রণ গরম করতে হবে। গরম করার সময় সবগুলো উপকরণ যেন ঠিকমতো গলে যায় তার জন্যে পরিষ্কার নাড়ানি দিয়ে মাঝে মাঝে নেড়ে দিতে হবে। 

এরপর উক্ত মিশ্রণ ১০ মিলি লিটার করে টেস্ট টিউবের মধ্যে নিয়ে টেস্টটিউবের মুখ ভালো করে তুলার ছিপি দিয়ে এঁটে দিতে হবে। অতঃপর উক্ত টেস্টটিউবগুলো অটোক্লেভ মেশিনে নিয়ে ২০ মিনিট যাবৎ জীবাগমুক্ত করতে হবে। 

অটোক্লেভ মেশিনের তাপমাত্রা রাখতে হবে ১২১৭ সেলসিয়াস ও প্রেসার বা চাপ রাখতে হবে ১.৫ কিলোগ্রাম কেজি)/সেমি^ (1.5kg/cm)। এরপর গরম টেস্টটিউব একটু কাত করে ঘণ্টাখানেক রাখার পরে পিডিএ মিডিয়া প্রস্তুত প্রণালি শেষ হবে। 

কাত করে রাখলে টেস্টটিউবের উপরের দিকে মাইসেলিয়াম গজানোর জন্যে একটু বেশি জায়গা পাওয়া যায়।

 পিওর কালচার প্রস্তুত প্রণালি:

 এবারে যে মাশরুমের জাত থেকে আমরা মাশরুমের স্পন প্যাকেট তৈরি করতে চাই, সেই মাশরুমের একটা তরতাজা বা ফ্রেশ (Juvenile) ফ্রুটিং বডি (মাশরুমের ফুলের পাপড়ির মতো অংশ) থেকে সার্জিকাল ব্লেড দিয়ে সরিষা দানার মত এক টুকরা কেটে নিয়ে পিডিএ মিডিয়া যে টেস্টটিউবে আছে তার মধ্যে আস্তে করে রেখে আবার টেস্টটিউবের মুখ বন্ধ করে ২০-২৫° সেলসিয়াম তাপমাত্রায় ৭-১২ দিন রেখে দিলে এ সময় টেস্টটিউবের ভেতরে মাশরুমের সাদা মাইসেলিয়ামে ভর্তি হয়ে যাবে। এই প্রক্রিয়াটি খুব সাবধানতার সাথে ল্যাবরেটরির ক্লিন বেঞ্চে করতে হবে। 

 

মানার কালচার প্রস্তুত প্রণালি: 

মাদার কালচার তৈরির জন্যে গম, ধান, কাউন বা কাঠের গুঁড়ো ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে গম ব্যবহারে ভালো ফল পাওয়া যায়। গম দিয়ে মাদার কালচার তৈরির সময় ঝাড়াই ও পরিষ্কার করে গম ১২-১৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে।

 তারপর সেই ভেজানো গম ভালো করে ধুয়ে নিয়ে ৩০-৪৫ মিনিট এমনভাবে ফুটাতে হবে যেন গম নরম হয় কিন্তু গমের দানা ফেটে না যায়।

 তারপর পানি ঝরিয়ে প্রতি কেজি গমের সাথে ১০ গ্রাম চুন বা ক্যালসিয়াম কার্বোনেট মেশাতে হবে। এরপর ৩০০ গ্রাম পরিমাণ হিটপ্রুফ পিপি ব্যাগে ভরে দিয়ে তাতে নেক লাগিয়ে রাবার ব্যান্ড দিয়ে বেঁধে রাখতে হবে। তারপর মুখে তুলা।

মুখ এঁটে রাবার ব্যান্ড দিয়ে ভালো করে বাধতে হবে। আগের মতোই প্যাকেটগুলো অটোক্লেভ মেশিনে নিয়ে এক ঘন্টা যাবৎ জীবাণুমুক্ত করতে হবে। অটোে মেশিনের তাপমাত্রা রাখতে হবে ১২১° সেলসিয়াস ও প্রেসার বা চাপ রাখতে হবে। 

১.৫ কিলোগ্রাম কেজি) / সেমি (1.5kg/cm)। অটোফ্রেড থেকে প্যাকেটগুলো নের করে ঠাণ্ডা জায়গায় রাখতে হবে। এরপর সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত পরিবেশে পিওর কালচার দিয়ে ইনোকুলেশন করে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রেখে দিলে ১৫-২০ দিনের মধ্যে সাদা মাইসেলিয়ামে প্যাকেট ভরে গেলে সেটাই হবে প্রকৃত মাদার কালচার।

 এই মাদার কালচার থেকে পরে বাণিজ্যিক স্পন তৈরি করতে হবে। বাস্তবে মাশরুমের বাণিজ্যিক স্পন তৈরি করা অবধি কয়েকটি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। 

বাণিজ্যিক স্পন তৈরির প্রক্রিয়া: 

বাণিজ্যিক স্পন তৈরির জন্যে আমরা দুটি বিকল্প পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারি, যেমন

 (১) অটোক্লেভিং পদ্ধতি এবং

 (২) পাস্তুরাইজেশন পদ্ধতি।

 অটোক্লেভিং পদ্ধতি:

 এই পদ্ধতিতে ১০০টি আধা কেজি ওজনের বাণিজ্যিক স্পন প্যাকেট তৈরির জন্যে প্রয়োজন হবে ১৬ কেজি কাঠের গুঁড়া, ৮ কেজি গমের ভুসি, ১ কেজি ধানের তুষ এবং ১০০ গ্রাম চুন বা ক্যালসিয়াম কার্বোনেট।

 এসব উপকরণের সাথে ২৫ লিটার পানি ভালোভাবে মিশিয়ে ১০ ইঞ্চি×৭ ইঞ্চি সাইজের পিপি ব্যাগে আধা কেজি মিশ্রণ দিয়ে ভর্তি করে তাতে নেক লাগিয়ে রাবার ব্যান্ড দিয়ে বেঁধে রাখতে হবে। তারপর মুখে তুলা দিয়ে মুখ এঁটে রাবার ব্যান্ড দিয়ে ভালো করে বাঁধতে হবে। 

সেই পূর্বের ন্যায় প্যাকেটগুলো অটোক্লেভ মেশিনে নিয়ে দুই ঘণ্টা যাবৎ জী করতে হবে। অটোক্লেভ মেশিনের তাপমাত্রা রাখতে হবে ১২১° সেলসিয়াম ও প্রেশার বা চাপ রাখতে হবে ১.৫ কিলোগ্রাম কেজি) /সেমি^ (1.5kg/cm’)। 

প্যাকেটগুলো ঠান্ডা হলে সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত পরিবেশে ১-২ চামচ মানার কালচার দিয়ে ইনোকুলেশন করে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রেখে দিলে ২০-২৫ দিনের মধ্যে সাদা মাইসেলিয়ামে প্যাকেট ভরে গেলে সেটাই প্রকৃত বাণিজ্যিক স্পন বা মাশরুমের বীজ প্যাকেট। 

পাস্তরাইজেশন পদ্ধতি: 

এই পদ্ধতিতে বাণিজ্যিক স্পন তৈরির জন্যে কাঠের গুঁড়ার সাথে এমনভাবে পানির পরিমাণ দিয়ে মিশিয়ে নিতে হবে যেন পানির পরিমাণ ৬৫ শতাংশ থাকে। এই মিশ্রণ নেটের ব্যাগে ভরে পাস্তুরাইজেশন চেম্বারে স্তরে স্তরে।

 সাজাতে হবে। বাষ্প দিয়ে পাস্তুরাইজেশন চেম্বারের তাপমাত্রা ৬০-৭০° সেলসিয়াস রাখতে হবে। এই অবস্থায় ১-১.৫ ঘণ্টা রাখতে হবে। 

এরপর এভাবে ১৮-২২ ঘন্টা রাখার পরে এই কাঠের গুঁড়ার অর্ধেক পরিমাণ পূর্বে প্রস্তুতকৃত মানার কালচার দিয়ে ভর্তি করে ভালোভাবে মিশিয়ে আধা কেজি প্যাকেট তৈরি করতে হবে। 

এভাবে তৈরিকৃত প্যাকেট র্যাকে রেখে দিলে ১০-১২ দিনের মধ্যেই মাইসেলিয়াম গজানো শুরু হবে।

এই পদ্ধতির অসুবিধা হলোঃ 

খুব বেশি পরিমাণ মাদার কালচার লাগে। তবে সহজ পদ্ধতিতে মানার কালচার তৈরি করা শিখে নিলে এই অসুবিধার অনেকটাই দূর করা 

মাশরুমের বীজ উৎপাদনের সতর্কতাঃ 

আপাতদৃষ্টিতে মাশরুম বীজের স্পন প্যাকেট দেখতে খুব সাধারণ মনে হলেও এই বাণিজ্যিক স্পন বা মাশরুম বীজ প্যাকেট তৈরি কিন্তু বেশ জটিল প্রক্রিয়া। এর জন্যে যেমন দক্ষ জনবলের দরকার তেমনি প্রতিটি স্তরে স্তরে প্রচণ্ড রকমের সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। মাশরুমের বীজ উৎপাদনে যেসব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে সেগুলো নিচে দেওয়া হলো: 

  • মাশরুমের স্পন প্যাকেট তৈরির পুরো কাজ ল্যাবরেটরিতে জীবাণুমুক্ত পরিবেশে করতে হবে, নইলে ভালো বীজ প্রাপ্তি ব্যাহত হবে। যেনতেনভাবে এই কাজটি কখনোই করা যাবে না।
  • মিশ্রণের সকল উপাদানের পরিমাণ কম বা বেশি করা যাবে না।  স্পন প্যাকেটের ভেতরে পানি জমে থাকলে সেসব প্যাকেট সরিয়ে ফেলতে হবে।
  • অটোক্লেভিং বা পাস্তুরাইজেশনের সময় তাপমাত্রা ও চাপ ঠিক রাখতে হবে। মাইসেলিয়ামের গ্রোথ যদি ঠিকমতো না হয় বা হলুদ বা অন্য কোনো রং হয়ে যায় তাহলে সেটা সরিয়ে ফেলতে হবে।
  • সর্বোপরি যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ এই কাজের সাথে জড়িত থাকবেন তাদের পোশাক-পরিচ্ছেদ এবং শরীরও পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।

 

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *